শচীন ও রাহুল

সলিলদা, অর্থাৎ সলিল চৌধুরী যিনি এই উপমহাদেশের আধুনিক সঙ্গীতের ঈশ্বর তিনি আমায় শচীন কর্তার সুরের প্রতি প্রথম আগ্রহী করে তোলেন । আর রাহুলদেব বর্মণের প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ টের পেয়েছিলাম, উন্মাদনা জেগেছিল বয়স যখন পনেরো কি ষোল । শচীন দেব বর্মণের কথায় আসি …। একদিন সত্যিকারের রাজকুমারের মতো যিনি পক্ষীরাজে করে বাংলার সুর বিশেষত কীর্তন ও ভাটিয়ালীকে পূর্ব পাড় থেকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন পশ্চিমের সমুদ্র পারে। বম্বের তাবড় সঙ্গিত পরিচালক দের মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন । জনপ্রিয় হয়েছিলেন দাদা বর্মণ নামে । গুরুদত্ত থেকে নভকেতন এর আনন্দ পরিবারের সকলে ছিলেন সচিন ভক্ত ।

গল্পটা আসলে এই যে ত্রিপুরার রাজ পরিবার ছেড়ে ছুড়ে বড়ো আশা নিয়ে কোলকাতায় এসেছিলেন ভালো করে গান বাজনা করবেন বলে। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ , কবি নজরুল এবং কৃষ্ণচন্দ্র দে র কাছে তালিম নিয়েছিলেন । কিন্তু এ বাংলায় খুব একটা কিছু করে উঠতে পারেন নি । ওঁর বিশিষ্ট নেজাল কণ্ঠস্বর যাতে আপামর ভারতবাসী মুগ্ধ হয়েছিল হিন্দি ছবির দৌলতে তা কিন্তু বাংলার তৎকালীন সুরবোদ্ধাদের কাছে তেমন একটা পাত্তা পায় নি। বম্বে জীবনেও প্রথম দিকে খুব একটা সফলতা না পেয়ে হতাস হয়ে পড়েছিলেন ।

তারপর একদিন গুরুদত্ত পূর্ব বঙ্গের সুরের প্রানভোমরা ভাটিয়ালী কীর্তন ছাড়াও কতো না রঙের লোকগীতি উঠে আসে তার গানে। বিশেষ ন্যাজাল টোন আর প্রতিটি গানে পূর্ববঙ্গের আন্তরিক শব্দচয়ন আপ্লুত করেছিলো সারা ভারতবর্ষকে। উনি ত্রিপুরার রাজবাড়িতে যেতেন। শুধু মাত্র হাতে তালি দিয়ে এবং তবলায় গানের সুর বাঁধতেন। ১৯৩২ এ প্রথম তাঁর গান রেকর্ডিং হয় হিন্দুস্তান রেকর্ডস এ।

বাংলার পান আর সানাই এর মেঠো সুর ছিলো বোধ হয় শচীন কত্তার গানের দুই জাদুমশলা । তার সাথে নস্টালজিক বাঁশির ব্যাবহার আর গায়কী সব মিলিয়ে তৈরী করেছিলো এক অভূতপূর্ব মধু নির্যাস।

তবে এ হেন সুরের জাদুকরের গানের এই বিশেষ মুন্সিয়ানাকে চিনতে ভুল করেছিলেন তৎকালীন গ্রামোফোন কোম্পানির কর্তারা। ভগ্ন হৃদয়ে বারবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হয় তাকে। গুরু দত্ত এবং নবকেতনরা কিন্তু বুঝে গিয়েছিলেন কি মিঠাস লুকিয়ে আছে কত্তার গানে, তাই তারা তাঁদের বিভিন্ন ছবিতে , আবহ সঙ্গীতে এই অবিস্মরণীয় কণ্ঠের জাদুর ব্যবহার করেছেন।আজও যে বাঙালী হিন্দি ছবির জগতে সগর্বে বেঁচে আছে তার প্রধান কাণ্ডারী শচীন কত্তা।বাংলার দুখিনী বর্ণমালায় শব্দ ও সুরের সপ্তডিঙ্গা ভাসিয়েছিলেন এই বঙ্গসন্তান। যার দ্যোতনা ছাপিয়ে গেছিলো ‘বর্ণে, গন্ধে, ছন্দে, গীতিতে’…অপূর্ব সুরের মাধুরীর ইন্দ্রজালে মুগ্ধ হয়েছিলো গোটা ভারতবর্ষ । বম্বের ছবিতে কীর্তনের সুর যখন লেগেছে তা হয়ে উঠেছে আরো আদরিনি । সে যেন তখন সত্যই বিশ্বময়ীর আসন বিছিয়েছে। ‘পিয়াসায়’ গীতা দত্তের কণ্ঠে যেন ভর করেছিলেন জন্মজন্মান্তরের রাধারানী।

‘আজ সাজন মোহে অঙ্গ লাগা লো’, ‘জনম সফল হো যায়ে’ ইত্যাদি গানে বাংলার নদীর দল আঁচল লুটিয়ে সমুদ্রপাড়ের অভিসারে চলে গিয়েছিলো। তাঁর বাউল গানের ঝুলিতে এরপর শুধু যুক্ত হয়েছে আশ্চর্যের পর আশ্চর্য। ‘জানে কেয়া তুনে কহী’, ইয়ে মেহলো ইয়ে তখতো ইয়ে তাজো কি দুনিয়া’ আজও আমাদের এক উদাসী জীবনসংশয়ের সামনে এনে দেয়।এরপরে ১৯৬৯ এ আরাধনা, বাবার সাথে যুক্ত হলেন ছেলে ‘রুপ তেরা মাস্তানা’,স্পনো কি রানী’, পিয়া তোসে নেয়না লাগে’ একের পর এক সফল গানে নতুন ভাবে সাড়া জাগলো। শচীন ,সলিল যখন মধ্য গগনে উদয় হলেন পঞ্চম। গুনবতী মাতা মীরা দেব বর্মণ এবং প্রবাদ প্রতিম শচীন দেব বর্মণের যশস্বী পুত্র রাহুল দেব বর্মণ। ট্রাডিশনের ওপর আস্থা রেখেই শুরু হলো এক চূড়ান্ত পরীক্ষা নিরিক্ষা। বলা যায় এযাবৎ গানের জগতে এলো এক ছেদ যাকে বলে ভাঙচুর। তাঁর গানে,তাঁর সুরে, তাঁর আবহে দুলে উঠলো Latin percussion।

সারা পৃথিবীর কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের সঙ্গীত blues, jazz, sole, rock তার সঙ্গে নেপালি মাদলের ছন্দ বিন্যাস মিলে মিশে এক নতুন ধারার জন্ম দিলো যা ভারতবর্ষের গানে এর আগে কেউ শোনেনি। কিন্তু এই ভাঙচুর মেনে নিতে পারেননি বাবা শচীন দেব। ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম” শুনে ক্ষোভ জন্মেছিলো তাঁর মনে ভাত্রিপ্রতিম অনুজ সঙ্গীতকার সলিল চৌধুরীর কাছে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে বলেছিলেন ‘সলিল ও আমার পোলা আর তোমার চ্যালা তুমি ওরে কও ও এসব কি করতাসে’? এই প্রসঙ্গে সলিল শচীন কে বলেন যে পঞ্চমের ব্যাপারে ভাবনার কিছু নেই,ও নিজস্ব সতন্ত্র পথ তৈরী করছে যা ভারতবর্ষের সঙ্গীতে এক নতুন দৃষ্টান্তের গল্পগাথা রচনা করে রাখবে।

সত্যি হয়েছে সলিল দার কথা অক্ষরে অক্ষরে ২০১৮ তেও সেইসব কালজয়ী গান পুরনো হয়নি। জন্মজন্মান্তরের মতোই এঁদের গানের সুর, আবহ, ছন্দের মূর্ছনা লেগে থাকবে ভারতবর্ষের সিনেমা তথা প্রত্যেক ভারতবাসীর অন্তরের মণিকোঠায়।