ক্যালকাটা

আলো আর নিঃসঙ্গ অন্ধকারের ভেতর আঙ্গুলের ঈশারা বিগত যৌবনা সেই অন্ধকার বিদিশার চোখে বৈদ্যুতিক শিহরন ।। 'যমুনাকে তীর' আর ফ্রী স্কুল স্ট্রীটের অলি-গলি বিধুর-বিষাদ….. লুপ্তপ্রায় স্বগোতক্তির মত আষাঢ় এসেছিল এক বিজন সমুদ্রপারে ।। ন্যাটকিংকোল, প্যাটবুন আর মোতর্জাটিয় আলোড়ন উচ্ছাস ! কালো…. সে যত কালোই হোক !

সেই কালো চাক্তির বুকের তীর ধরে পিনের আলগা ছোঁয়ায় নেশা ধরানো ঘষা শব্দের পারাপারে গান গেয়ে উঠতেন আব্দুল করিম কিংবা লুই আমস্ট্রং । আলি আকবর খান সাব, ডিউক এলিংটন । থমকে যেত বুকের ধুকপুক । বিবশ হত শিরায় বয়ে যাওয়া যুগান্তের আদিম বাতাস । একটা সরু কালো দাগের ঘূর্নীতে লুকোনো ছিল পৃথিবীর দীর্ঘতম বিলম্বিত সময় । ৭৮ আর.পি.এম । প্রথম প্রেম ।

এমন মানুষকে চিনতাম যিনি বলে বলে মিউজিকের যে কোনো তাল ছন্দ মাত্রায় গ্রামাফোনের সেই কালো চাক্তিতে নির্ভুলভাবে পিন সেঁটে দিতে পারতেন । অন্য কিসমের মানুষ ছিলেন তারা । আমার বালক বয়সে বাবাকে দেখেছি এমন অদ্ভুত যাদু দেখাতে । বাড়িতে খুব খাতির ছিল তাঁদের । ছিল আলাদা কাঠের আলামারি । বাইরে কাঁচ দিয়ে দেখতে পেতাম । ছোঁয়া বারণ ছিল । দূর থেকে সমীহ ভরে শোনার অনুমতি ছিল । প্রথম এই একচেটীয়া ব্যাপারটা একটু আলাগা হল যখন নিউ থিয়াটার্সের সামনে মিত্র ইলেট্রিক্সের দোকানে বছরের কিছু নির্দিষ্ট দিন মেনে পূজো-পার্বনে কিংবা রবীন্দ্র-নজরুল তিথিতে বাজানো হত গান । আমরা উঁকি- ঝুঁকি মারতাম । ক্লাস সিক্সে সেই খোলাবাজারে নিজের হাতে রেকর্ড চালাবার অধিকার পেয়েছিলাম আমি । আমার হাতেখরি অলোক মিত্রের হাতে । ঠিকঠাক ভাবে রেকর্ডে পিন বসানো , গান থামলে আবার যথাস্থানে….

হঠাৎ কারেন্ট চলে গেলে কি করতে হবে এইসব আর কি । তিয়াত্তরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথমবার ববিকে ছুঁয়েছিলাম । সেই প্রথম । ববি তখন নেশায় নেশায় ঘুরতে লেগেছে আর একটার পর একটা – ভোলা যায় সেসব দিন ! একটা কামরায় দুজন আটকে যাওয়া আর চাবি হারিয়ে যাওয়ার গান । পাশের দোকানে এসে অমিতা অপলক চোখে চেয়েছিল । রেকর্ড বাজানোয় দক্ষ আমি টুক করে ববির গায়ে একটা অন্য কভার চাপিয়ে দিয়েছিলাম । সেই প্রথম অবৈধ প্রেমের স্বাদ । লুকোনোর ভয় আর পরিতৃপ্তি একসাথে । এর কিছুদিন পরে বয়স যখন ষোলো সতেরো ওইরকম সময় থেকে নিয়মিত ধর্মতলা, ফ্রী-স্কুল স্ট্রীট এইসব জায়াগায় চলে যেতাম । বেশিরভাগ সময়ই বন্ধুবান্ধব থাকতো । কখনো একা । আমার বেহালা বেলা তখন প্রাপ্ত বয়স্ক । ফ্রী-স্কুল স্ট্রীটে খোঁজ চলত ভায়োলিনের ঈশ্বরীয় সব মানুষজনের বাজানো কালো চাক্তির । ডেভিড অয়স্ট্রাক, হাইফেজস, পার্লম্যান, ইহুদী মেনহুইন । কনচের্তো আর সিম্ফনি সকল । এরই পাশে বয়সের ধর্ম মেনে ভেঞ্চার্স , রন গডউইনের আরাবিয়ান নাইটস , সোলমাকোসা… এইসব চলতে লাগল । আমার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ঠাকুমা । এবং সেইহেতু ঠাকুমার অনেক খিদমদগিরি করতে হত আমায় ।

অকালবৈশাখী আর বিপন্ন মধ্যরাতের বিজন তারা ।। মোহিনী সব কভার গার্লের বিদ্যুৎ চুম্বন….. আঠারো কলার যৌবন তাপ উত্তাপ…. ' ঈশ্বর- পৃথিবী -ভালোবাসা ' তৎসহ কালো চাক্তির নিরাভরন ব্যালে ।

কালো চাক্তির অলি-গলি তস্য গলি চিনে ফেলেছি তখন । বিশেষ করে পার্কস্ট্রীট পাড়া । কার্নানি ম্যানসনের এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ভদ্রলোকের কালেকসান ছিল সাংঘাতিক । জ্যাজ, ব্লুস, রক অ্যান্ড রোলের তীর্থঘর ছিল । সেখান থেকেই ফ্রী স্কুল স্ট্রীটের জীবনলাল সাউ, মহম্মদ আলাহির এত রমরমা । আমাকে এই ঠেকটির খোঁজ দিয়েছিলেন কলকাতা তথা ভারতবর্ষের জ্যাজের কিংবদন্তী মিউজিশিয়ান অ্যান্টমেনেজাস । নিয়মিত এদের রেসের মাঠে যাতায়াত ছিল । কদাচিৎ জিতলে আমি গিফট হিসেবে পেয়েছি একটা নতুন কিছু । নেইল ডায়াম্যান্ড । হট অগষ্ট নাইট ।

নতুন এ পৃথিবীতে উষ্ণতা কমেছে কিছু । সেসব মহার্ঘ্য সময় চোখের সামনে নিতান্তই রেজগিতে পরিণত হল দেখলাম । ৭৮ আর.পি.এম হয়ে গেল সরু ফিতেয় বন্দি । ক্যাসেটে ধরা হল তাল, সুর, লয়, ছন্দ । সেসব পেরিয়ে কমপ্যাক্ট ডিস্ক । কালোর মাহাত্ত তখন রূপোলি চাক্তিতে । সেসবও এখন অচলপ্রায় । এখন শ্রবণ শুধুই ডিজিটাল । হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে যাদের কাছে এখনও রয়ে গেছে কালো চাক্তি তারা ভিন্টেজের সম্মান টম্মান পান । লেনিন সরনী ফ্রী স্কুল স্ট্রীটের গরীমা কমেছে । বিশ্ববিপননীর শ্রবণ এখন হাতের মুঠোয় । মোবাইল, ব্লু-টুথ, পেন-ড্রাইভ, এই অ্যাপ, ওই অ্যাপ…..

হেমেন্দ্রলাল বোস, মানে এইচ.এল.বোস এই নামটির সঙ্গে বাংলা গানের দীর্ঘ ইতিহাস । পরাধীন ভারতে ইনিই প্রথম রেকর্ড করা শুরু করেন এই বাংলায়, এই কলকাতায় । সেসব রেকর্ডিং এর ডিস্ক নিজেই তৈরী করতেন, এদেশে গ্রামোফোন কোম্পানীর বহু আগে । রবীন্দ্রনাথ, গহরজান ও বহু শিল্পী ওনার কাছে রেকর্ড করে এসেছেন । আমূল পাল্টে যাওয়া সময়ে গানবাজনার অবস্থানও পাল্টেছে । গ্রামাফোন কোম্পানি এখন পাঁচ হাজার গানকে একসঙ্গে একটি বকচ্ছপ জাতিও বস্তুতে পুরে দিচ্ছে । বিনিময় মুল্য পাঁচ হাজার টাকা । যার অর্থ প্রতি গানের মুল্য এক টাকা । ভাবা যায় ! তবুও মানুষ কিন্তু গান শুনছেন । পিন ঘষার অপার্থিব সেই আওয়াজের রেশ কারোরই স্মৃতিতে আর নেই । নতুন করে পুরনো রেকর্ডের সংরক্ষণ হচ্ছে যখন সেই ঘসা আওয়াজকে টেকনোলজি নয়েস বলে মার্ক করছে । হায় ! নয়েস ও যে সঙ্গী ও সঙ্গীত… কে বোঝাবে তাকে ? আর তাই বিশুদ্ধ সঙ্গীত বড় পানসে হয়ে যাচ্ছে কিছুদিনের মধ্যেই । কে জানে হয়তো এমনও দিন আসবে যে পুরো মিউজিক রেকর্ড করার পর খানিকটা পিন ঘসা আওয়াজ যুক্ত করবে টেকনোলজি । তবে আপাতত কালো চাক্তি বাতিল ।

পুনশ্চঃ – একটি ইতালিও গ্যাসপ্যারো ভায়োলিন বেচে জনৈক এক কিশোর তার প্রেমিকাকে ৭৪-টি বাখ, বেঠোফেন, শোপ্যাঁ… ইত্যাদি রেকর্ড কিনে দিয়েছিলেন মধ্য আশির দশকে । ভায়োলিনটি কোথাও না কোথাও আছে । রেকর্ডগুলির ঠিকানা কেউ বলতে পারলে জনৈক প্রৌঢ় সেগুলি কালেক্টর আইটেম হিসেবে পুনঃক্রয় করিতে ইচ্ছুক ।