আমার মাস্টারমশাই

ভায়োলিন নাকি বেহালা ! নাকি দিলীপ রায় । আমার কিশোর বয়সে কখন যেন একাত্ত হয়ে গিয়েছিল এই তিনটি শব্দ । সত্তর দশকের শেষ ভাগে এই মানুষটির বেহালার সুরে উদ্বেল হয়েছিল বাঙ্গালি শ্রোতা । ফিল্ম বা ননফিল্ম গানের প্রিলিউড ইন্টারলিউড আর গানের গায়ে জড়িয়ে থাকা musical arrangenment তার অনবদ্য ছড়ির টানে প্রান পেত । এই অফুরন্ত প্রান মানুষটিকে আমি আমার গুরু হিসেবে পেয়েছিলাম । আমার প্রিয় মাস্টারমশাই ।তার বাজনায় কে না তখন মুগ্ধ ! সুচিত্রা, কনিকা, দেবব্রতদের একান্ত প্রিয় ছিলেন তিনি । অন্যদিকে হেমন্ত, সলিল , সুধীন , নচিকেতা-দের recording -এর দিন ঠিক হতো অনেকটাই এই মানুষটির এভেলিবিলিটির উপর । অলোকনাথ দে , Y.S.Mulki , দিলীপ রায় – এই তিনজন ছাড়া কোন recording- ই যে সম্ভব হয়ে উঠত না সেই সময় । ভায়োলিন ছাড়াও ওনার দক্ষতা ছিল যে কোন জটিল সুরকে অবলীলাক্রমে স্বরলিপিতে সাজিয়ে ফেলা ।

এত নিখুঁত ভাবে বুঝিয়ে দিতে পারতেন যে খুব কঠিন মিউজিকও সহজে শিল্পীরা তুলে নিতেন তাদের বাদ্যযন্ত্রে । এই দক্ষতার কারনে সত্যজিৎ রায় ,রবিশঙ্করের মতো বিশিষ্ট শিল্পীরাও একান্তভাবে দিলীপ রায়কে চাইতেন তাদের নিজেদের recording floor-এ ।

এই লেখা যখন লিখছি হটাৎ – ই আলো হয়ে উঠলো চারিধার … যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি , দিলীপ রায়ের কোন এক recording floor…. অমর লাহা , anto menezes , শুভেন দে, খোকন মুখার্জিদের মতো বাঘা বাঘা মিউজিশিয়ানরা একদিকে আর অন্যদিকে সদ্য oxford mission থেকে আসা কিশোর বয়সি সব violinist-রা , technician studio-র ঠিক মাঝখানে বসে একাগ্রমনে মান্না দের থেকে গানের সুর লিখে নিচ্ছেন নিজের সহজাত ভঙ্গিমায় এবং তারপর তাকে arrangement-এর জাদুতে প্রান প্রতিষ্ঠা করছেন । সদাহাস্য মুখ । শান্ত অথচ দৃঢ় । একটা আলো যেন লেগে আছে চোখে । দিলীপ রায়ের recording floor মানে নবীন বরন । পুরনোদের সঙ্গে সত্যি অর্থেই কচি কাচারা জুটে যেত । তারাই আজকে অনেকে দিকপাল । কিন্তু সেদিন সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা এই মানুষটিই ছিল তাঁদের আশ্রয় । যদি বলি কি শিখেছি এই অনন্য গুনের বিশিষ্ট শিল্পীর কাছে, তাহলে বলবো যে ডিসিপ্লিন ।

আমি মিউজিসিয়ান হয়ে যখন কাজ করছি ওনার সাথে তখন কিন্তু তিনি আর আমার মাস্টারমশাই নন । অন্য যে কোন মিউজিসিয়ানদের মতই । আর ঠিক recording-এর শেষে যখন বাড়ি যেতাম খোঁজ নিতেন আমার প্রতিটি বিষয়ের । আমি পড়াশুনা করছি কিনা , আরও নতুন কিছু শিখছি কিনা …. এইসব । আজও স্পষ্ট দেখতে পাই দিলীপ রায়ের হাতের লেখা স্কোর । ঠিক যেন বিদেশী কোনও কম্পোজার এর লেখা স্কোর । কে কতটা বাজাবে, ঠিক কোন খানে থামতে হবে, কোথায় কমে যাওয়া, কোথায় বেড়ে যাওয়া এই সব নিখুঁত ডিসিপ্লিন-এ লেখা । ৩৫৫ সোনার কেল্লা ছবি । রাজস্থানের পটভূমিতে বাজবে রাবনহাথা ।

যা অনেকটা আমাদের সারিন্দার মতো । কিন্তু মুশকিল হলো বাজাবেটা কে ? দিলীপ রায় বেহালায় প্রথাগত টিউনিং পাল্টে দিয়ে একটা অনবদ্য স্বর বার করলেন । সত্যজিৎ রায় অবাক হয়ে গিয়েছিলেন । এর পরবর্তী violinist-রা খুব সহজেই এখন এগুলো করে থাকেন । কিন্তু শুরুটা হয়েছিল ওইখান থেকেই । আমার তখন কিশোর বয়স , আমি ও আমার দাদা মাস্টারমশাই- এর বাড়িতে যেতাম ভায়োলিন-এ দেশীয় বাজনা শিখতে । তখনও সলিল চৌধুরীর সঙ্গে আমার দেখা হয় নি । উনি খুব যত্ন করে শেখাতেন এবং উনিই বলেছিলেন যে সলিল চৌধুরীর গানের ইন্টারলিউডগুলো ভাল করে বাজালে সেটাই হবে একটা দারুন practice । এটা আমরা মিউজিসিয়ানরা আজও হাড়ে হাড়ে টের পাই ।

এই শেখার কারনেই হয়তো পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন composer, arrangers -দের সঙ্গে কাজ করে যেতে পেরেছি । মাস্টারমশাই চিন্তা ভাবনায় ছিলেন অত্যন্ত আধুনিক । আর সেই কারনেই তরুন মিউজিসিয়ানদের কাজ ওনার recording থেকেই শুরু হয়েছে । যদি বলা হয় এই সঙ্গীতকারের বৈশিষ্ট্য কি ছিল , তা হলে বলবো ওনার orchestration – এ ছিল একটা সরল স্বাভাবিক দিক । গানের মেজাজকে খুন্ন না করে কিভাবে গানকে শ্রোতার কাছে আপন করে তোলা যায় এই arrangement এর ধারা আজ এই সময়েও শিক্ষণীয় । "একগোছা রজ্নীগন্ধা " গানটির মধ্যে মন কেমন করা ভায়লিনের মেলোডিটি যখন বেজে ওঠে তখন আজও আবাক হতে হয় । এ শহরের প্রতিটি মিউজিশিয়ান কিছু না কিছু শিখেছি দিলীপ রায়ের কাছে । যা শেখা যায় না তা হলো অমায়িক ও সত্যি অর্থের নিরঅহঙ্কারী মামানুষটির সরল ব্যাক্তিত্বকে । শরীর চলে যায় । চলে যেতে হয় । ছেড়ে যেতে হয় সব টান এই ভুবনের । শুধু থেকে যায় কাজ আর তাই বাংলা গানের সত্তর আশির দশক চিহ্নিত থাকবে দিলীপ রায়ের ভায়োলিনের মূর্ছনায় । বিনম্র প্রণাম জানবেন… মাস্টারমশাই ।